অনিন্দ্যর লেখা
আজ, ৭ আগস্ট ২০২৫, আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি ভারতীয় কমেডি চলচ্চিত্রের এক অবিস্মরণীয় নাম — কেষ্ট মুখার্জিকে। আজ তাঁর জন্মের শততম বর্ষপূর্তি। তিনি এমন এক অভিনেতা, যিনি কখনো নায়ক ছিলেন না, তবে প্রেক্ষাগৃহ থেকে শুরু করে দর্শকের হৃদয়ের মঞ্চ — সর্বত্রই ছিলেন অনন্য, অতুলনীয়। তাঁর হাস্যরস ছিল নির্ভেজাল, তার অভিনয় ছিল জীবনঘনিষ্ঠ। একবিংশ শতাব্দীর ডিজিটাল যুগে দাঁড়িয়েও কেষ্ট মুখার্জির হাসির দৃশ্যগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়ায়, প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাকে মনে রাখে এক গভীর ভালবাসায়।

জন্ম ও শুরুর দিন
১৯২৫ সালের ৭ আগস্ট কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন কেষ্ট মুখার্জি (Kesto Mukherjee)। তাঁর পরিবার ছিল মধ্যবিত্ত, সাংস্কৃতিক আবহে বড় হওয়া এই মানুষটির অভিনয়ে হাতেখড়ি থিয়েটারেই। কিন্তু জীবনের বাস্তবতা, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন আর কাজের খোঁজ তাঁকে ঠেলে দেয় মুম্বইয়ের চলচ্চিত্র জগতে।
বলিউডে যাত্রা : ‘মদ্যপ’ চরিত্রে অমরতা
কেষ্ট মুখার্জিকে প্রথম বড়সড় চেনা যায় ১৯৫০-৬০-এর দশকের হিন্দি ছবিতে। তাঁর সবচেয়ে পরিচিত এবং বিখ্যাত পরিচয় – মাতাল চরিত্রে। আজকাল এই ‘টাইপকাস্ট’ হবার অভিযোগে শিল্পীরা ক্ষুব্ধ হন, কিন্তু কেষ্ট মুখার্জি এই রোলকেই পরিণত করেছিলেন শিল্পে।
“Padosan” (১৯৬৮), “Chupke Chupke” (১৯৭৫), “Bombay to Goa”, “Sholay” বা “Amar Akbar Anthony” — প্রতিটি ছবিতে তাঁর সংক্ষিপ্ত উপস্থিতিও হয়ে উঠতো দর্শকের প্রিয় মুহূর্ত।
তিনি ছিলেন সেই বিরল অভিনেতাদের একজন, যিনি সংলাপ ছাড়াও হাসাতে পারতেন। তাঁর চোখ, হাঁটা, এক্সপ্রেশন — সব কিছুতেই ছিল নিখুঁত কমিক টাইমিং। পরিচালকরাও জানতেন, একটি দৃশ্য জমাতে হলে সেখানে কেষ্ট মুখার্জির একটি মুখভঙ্গিই যথেষ্ট।

ব্যতিক্রমী অভিনেতা, ব্যতিক্রমী জীবন
কেষ্ট মুখার্জির ব্যক্তি জীবন ছিল অভিনয়ের মতোই সাধারণ। কখনো তিনি প্রচারে আসেননি, কোনো বিতর্কে জড়াননি। পত্রপত্রিকায় তেমন সাক্ষাৎকারও দেননি। অথচ সেই নীরব জীবনের ভিতর লুকিয়ে ছিল শত শত মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর মন্ত্র। তাঁকে নিয়েও হাসাহাসি হত, কিন্তু কেউ তাঁকে অপছন্দ করত না।
দারিদ্র্য ছিল তাঁর ছায়াসঙ্গী, অনেক সময় ন্যূনতম পারিশ্রমিকেও কাজ করতেন। কিন্তু সেটে তিনি থাকলে সকলের মুখে হাসি ফুটত। তিনি ছিলেন এক অনির্বচনীয় প্রাণবন্ততা।
বাংলা চলচ্চিত্রেও অবদান
যদিও কেষ্ট মুখার্জি হিন্দি চলচ্চিত্রেই বেশি কাজ করেছেন, তবুও বাংলা ছবিতেও তাঁর অবদান উপেক্ষা করার মতো নয়। সত্যজিৎ রায়ের “পরশ পাথর”-এ তাঁর উপস্থিতি অনেকের স্মৃতিতে আজও অমলিন। তিনি ছিলেন বাংলা ও হিন্দি — দুই ভাষার চলচ্চিত্রের মাঝখানের সেতু, যা আজও বিরল।
বিদায় ও উত্তরাধিকার
১৯৮২ সালে মাত্র ৫৭ বছর বয়সে কেষ্ট মুখার্জি পৃথিবীর মঞ্চ ছেড়ে বিদায় নেন। কিন্তু রয়ে গেছে তাঁর অসংখ্য চলচ্চিত্র, যেগুলো এখনও টেলিভিশনে কিংবা ইউটিউবে দেখে মানুষ হেসে ওঠে।
তিনি ছিলেন ‘হাসির সংজ্ঞা’ — এক আশ্চর্য সময়ে, যেখানে কমেডির জন্য আলাদা কোনো স্ট্যান্ড আপ স্টেজ ছিল না, তবুও তিনিই ছিলেন ‘স্ট্যান্ড আউট’।

এক নিঃশব্দ শ্রদ্ধাঞ্জলি
আজ তাঁর জন্মশতবার্ষিকীতে কোনো জাঁকজমক নেই, কোনো রাষ্ট্রীয় পুরস্কার বা বিশেষ সম্মেলন নেই হয়তো। কিন্তু আকাশবাণীতে এখনও যখন পুরনো হিন্দি ছবির গান বাজে, বা কোনো ইউটিউব রিল-এ ভেসে আসে তাঁর বিখ্যাত সংলাপহীন মাতালের অভিনয় — তখনই প্রমাণ হয়, “হাসির রাজা” কেষ্ট মুখার্জি আজও অমর।
তাঁর প্রতি রইল বিনম্র প্রণাম।
হয়তো তিনি নিজে বলতেন,
“আরে মদ খেয়েছি ঠিক আছে, কিন্তু হাসানোও তো একটা কাজ, না?”
আর আমরা সবাই বলি —
হ্যাঁ কেষ্টদা, আপনার কাজই আমাদের হাসি ফিরিয়ে আনে।