কলকাতায় গণেশ চতুর্থী ও মহানায়কের গল্প
— যেখানে এক উৎসবের সূচনা জড়িয়ে আছে উত্তম কুমারের সঙ্গে

কলকাতা মানেই দুর্গাপুজোর শহর। শরতের হাওয়া, ঢাকের তালে মেতে ওঠা, ঠাকুর দেখার ভিড়—সবটাই যেন এই শহরের চেনা ছন্দ। কিন্তু গত কয়েক বছরে দেখা যাচ্ছে, শহরের উৎসবের ক্যালেন্ডারে ধীরে ধীরে জায়গা করে নিচ্ছে আরেকটি উৎসব—গণেশ চতুর্থী। যা একসময় মূলত মহারাষ্ট্র, গোয়া বা দক্ষিণ ভারতের মানুষের ঘরোয়া বা স্থানীয় মণ্ডলমুখী অনুষ্ঠান ছিল, সেটাই এখন কলকাতার পুজো সংস্কৃতিরও এক অংশ হয়ে উঠেছে।
কিন্তু জানেন কি? কলকাতায় প্রথম গণেশ চতুর্থী পালনের কৃতিত্ব যায় বাংলার সিনেমা জগতের সর্বকালের প্রিয় মুখ—মহানায়ক উত্তম কুমার-এর কাছে।

উত্তম কুমারের হাত ধরে এক নতুন উৎসব
ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়। বাংলা সিনেমা তখন উত্তম-সুচিত্রার স্বর্ণযুগ পার করছে। কিন্তু চলচ্চিত্রের ব্যস্ততার মধ্যেও উত্তম কুমার ছিলেন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চেতনায় ভরপুর মানুষ। সিনেমার শুটিংয়ে মহারাষ্ট্রে গিয়ে তিনি কাছ থেকে দেখেছিলেন সেখানকার গণেশ চতুর্থীর আড়ম্বর, একতা ও আনন্দ। সেই অভিজ্ঞতা তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
কলকাতায় ফিরে এসে তিনি ভাবেন—দুর্গাপুজোর মতোই, এই গণেশ চতুর্থীও যদি মানুষের মিলনমেলা হয়ে ওঠে, তবে উৎসবের আনন্দ আরও বহুগুণে বাড়বে। তাঁর ব্যক্তিগত উদ্যোগে দক্ষিণ কলকাতায় প্রথমবার আয়োজন হয় গণেশ পুজোর।

প্রথম আয়োজন: এক অভিনব প্রয়াস
প্রথম বছর পুজো হয় একেবারেই ঘরোয়া পরিবেশে। তবে উত্তম কুমারের জনপ্রিয়তার কারণে সেই ছোট্ট আয়োজনেই ভিড় জমে যায় অগণিত মানুষের। শুধু সিনেমা জগতের তারকারাই নয়, প্রতিবেশী ও সাধারণ মানুষও উচ্ছ্বসিত হয়ে অংশ নেন সেই পুজোতে।
প্রথা অনুযায়ী, মহারাষ্ট্র থেকে আনা হয় গণেশের মূর্তি। উত্তম কুমার নিজে নেতৃত্ব দেন বিসর্জনের শোভাযাত্রায়। ঢাক-ঢোল, শঙ্খধ্বনি, ফুলের বর্ষণ—সব মিলিয়ে দক্ষিণ কলকাতার রাস্তায় সেদিন যেন এক নতুন উৎসবের জন্ম হয়।

ধীরে ধীরে শহরের হৃদয়ে
উত্তম কুমারের উদ্যোগ যে শুধু এক বছরের জন্য ছিল না, তা প্রমাণ করে পরবর্তী সময়। তাঁর অনুপ্রেরণায় আরও কয়েকটি ক্লাব ও সংগঠন গণেশ চতুর্থী পালনের উদ্যোগ নেয়। প্রথমে দক্ষিণ কলকাতা, পরে উত্তর কলকাতা ও শহরতলির ক্লাবগুলোও যুক্ত হয় এই উৎসবে।
আজকের দিনে কলকাতার গণেশ উৎসবের রঙ, সঙ্গীত, ও মণ্ডপসজ্জা দেখলে বোঝাই যায় না, এটি একসময় কত সীমিত পরিসরে শুরু হয়েছিল। কিন্তু ইতিহাসে নাম থাকবে—এই শহরে গণেশ চতুর্থীর বীজ বপন করেছিলেন এক মহানায়ক।
উত্তরাধিকার ও স্মৃতি
উত্তম কুমারের জীবদ্দশায় তাঁর শুরু করা এই উৎসব কেবল আনন্দ নয়, বরং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। আজও কলকাতার গণেশ উৎসবের আয়োজনকারীরা বহুবার উল্লেখ করেছেন, “যদি উত্তমবাবু সেই সময় উদ্যোগ না নিতেন, হয়তো কলকাতায় এই উৎসব এত দ্রুত জনপ্রিয় হত না।”
এ যেন এক মহানায়কের দেওয়া উপহার—যা সময়ের সঙ্গে আরও বড় হয়েছে, আরও রঙিন হয়েছে। দুর্গাপুজোর শহরে এখন গণেশ চতুর্থীও এক গুরুত্বপূর্ণ উৎসব, আর এর পেছনে রয়েছে একজন মানুষের দৃষ্টি, উদারতা ও সাংস্কৃতিক ভালোবাসা।
উৎসব মানেই মিলন, আনন্দ ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন। আর উত্তম কুমারের শুরু করা কলকাতার গণেশ চতুর্থী তারই এক উজ্জ্বল উদাহরণ—যেখানে সিনেমার পর্দা পেরিয়ে এক মহানায়ক মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন আরও একবার, এক নতুন উৎসবের মাধ্যমে।