আগামীকাল, শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমা তিথি—বাংলা ক্যালেন্ডারের এক বিশেষ দিন, রাখি পূর্ণিমা। রাখি মানেই শুধু একটি রঙিন সূতো নয়, এটি হলো সম্পর্কের এক নীরব শপথ, বিশ্বাসের প্রতীক, আর ভ্রাতৃত্ব ও স্নেহের চিরন্তন স্মারক।
উৎসবের আদি কাহিনি
রাখি পূর্ণিমার উৎপত্তি নিয়ে নানা কিংবদন্তি প্রচলিত। মহাভারতের পটে আমরা পাই দ্রৌপদী ও কৃষ্ণের গল্প। একদিন কৃষ্ণ আঙুলে আঘাত পেলে রক্তপাত হয়। দ্রৌপদী তৎক্ষণাৎ নিজের শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে তাঁর আঙুলে বেঁধে দেন। সেই মুহূর্ত থেকে কৃষ্ণ প্রতিশ্রুতি দেন—যে কোনো বিপদে তিনি দ্রৌপদীর রক্ষা করবেন। এই প্রতিশ্রুতির প্রতীকই ধীরে ধীরে রাখি বন্ধনের রূপ নেয়।

আরেকটি ঐতিহাসিক ঘটনা মুঘল যুগের। বলা হয়, রাজপুত রানি কর্ণাবতী দিল্লির সম্রাট হুমায়ুনকে একটি রাখি পাঠিয়ে নিজের রাজ্যের সুরক্ষার জন্য আহ্বান জানান। হুমায়ুন প্রতিশ্রুতির মর্যাদা রেখে তাঁর সেনা পাঠান রানিকে রক্ষা করতে।

বাংলার রাখি ও রবীন্দ্রনাথের ‘রাখি বন্ধন’
বাংলায় রাখি পূর্ণিমা শুধু ভাই-বোনের উৎসব নয়—এটি একসময় সমাজ ও জাতিগত ঐক্যের প্রতীক হয়েছিল। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘রাখি বন্ধন দিবস’-এর প্রচলন করেন। তিনি হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে মানুষকে একে অপরের হাতে রাখি বেঁধে ভ্রাতৃত্বের শপথ নিতে আহ্বান জানান। সেই দিন বাংলার পথে পথে ভ্রাতৃত্বের সূতোয় গাঁথা হয়েছিল মানুষের মন।

উৎসবের রঙ ও রীতি
ভোরবেলা ভাইবোনেরা স্নান সেরে পুজোর প্রস্তুতি নেয়। বোন ভাইয়ের হাতে রাখি বেঁধে তার দীর্ঘায়ু ও মঙ্গল কামনা করে। ভাই উপহার দিয়ে প্রতিশ্রুতি দেয়—বোনকে সবসময় রক্ষা করবে। আজকাল শহরে দোকান সাজে রঙিন রাখি, চকোলেট, উপহারের প্যাকেট আর মিষ্টির দোকানগুলো জমজমাট হয়ে ওঠে রসগোল্লা, সন্দেশ, লাড্ডুর সুবাসে।

আধুনিক প্রেক্ষাপটে রাখি পূর্ণিমা
আজকের দিনে রাখি পূর্ণিমা শুধু আত্মীয় ভাই-বোনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। অনেকেই আত্মীয়তা ছাড়াও বন্ধু, প্রতিবেশী কিংবা সহকর্মীর হাতেও রাখি বাঁধেন—একটি মানবিক বন্ধনের বার্তা ছড়িয়ে দেন। কর্পোরেট অফিস থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ, এমনকি সেনাবাহিনীর জওয়ানদের হাতেও পৌঁছে যায় এই ভালোবাসার সূতো।

ভ্রাতৃত্বের এই চিরন্তন দিন
রাখি পূর্ণিমা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—রক্তের সম্পর্ক হোক বা হৃদয়ের, ভ্রাতৃত্বের বন্ধন যত্নে লালন করলে তবেই তা অটুট থাকে। আগামীকাল যখন সূর্যের আলোয় আকাশ ভরে উঠবে শ্রাবণের পূর্ণিমার মায়ায়, তখন অসংখ্য বোন ভাইয়ের হাতে রাখি বেঁধে নীরবে প্রতিজ্ঞা করবে—”যে কোনো সময়ে, আমরা একে অপরের পাশে থাকব।”