দুর্গোৎসব বাঙালির জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দোৎসব। শরতের আকাশে সাদা কাশফুল দোল খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাঙালির মনে এক অন্যরকম উত্তেজনা জেগে ওঠে—পুজোর সাজ। তবে এই সাজ আজকের দিনে যেমন, কয়েক দশক আগেও কিন্তু একেবারেই আলাদা ছিল। সমাজ, অর্থনীতি আর ফ্যাশনের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গিয়েছে সাজের ধরণ, রঙ, উপকরণ—এমনকি সাজের মানসিকতা পর্যন্ত।
সেকালের সাজ
তিন-চার দশক আগে পুজোর সাজ মানেই ছিল একেবারে ঘরোয়া আয়োজন। পুজোর আগেই পরিবারের মেয়েরা দর্জির কাছে কাপড় দিয়ে আসতেন। তখনও বাজারে এত রেডিমেড জামাকাপড়ের চল ছিল না। জামদানি, ঢাকাই, তাঁতের শাড়ি কিংবা কটনের ফ্রক—সবই হাতে বানানো হতো। একেকটা জামা তৈরি করতে দর্জির সময় লাগত, আর সেই জন্যই জামাকাপড় পাওয়ার আনন্দটা ছিল অন্যরকম।


ছেলেরা পেত নতুন পাঞ্জাবি বা শার্ট, সঙ্গে সাধারণ সুতির পাজামা। কারো কারো ভাগ্যে থাকত ধুতি। মেয়েদের জন্য থাকত নতুন শাড়ি বা সালোয়ার-কামিজ, অনেক সময় মায়ের পুরোনো শাড়িই কেটে বানানো হতো জামা। সাজগোজ বলতে সাদামাটা কাঁচের চুড়ি, লাল ফিতে বা খোঁপায় জুঁই ফুল। মুখে সামান্য পাউডার, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক।
পুজোর সাজ শুধু পোশাকেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বাড়ির বারান্দায় আলপনা, মাটির প্রদীপ, ফুল দিয়ে সাজানো বাসনপত্র—এসবও ছিল সাজের অংশ। গ্রামের বাড়িতে তো সাজের সঙ্গে জড়িয়ে থাকত নারকেলপাতা, কলাপাতা আর রঙিন কাগজের ঝালর। সেই সাজে ছিল আন্তরিকতা আর ঘরোয়া টান।
একালের সাজ
আজকের দিনে পুজোর সাজ অনেকটাই বদলে গিয়েছে। বিশ্বায়নের প্রভাবে ফ্যাশনের নতুন ধারা এসে গেছে আমাদের জীবনে। এখন শপিং মল, ডিজাইনার বুটিক, অনলাইন শপিং—সব মিলিয়ে পোশাক পাওয়া সহজ আর বৈচিত্র্যময়। পুজোর আগে বাঙালি ছেলেমেয়েরা ছুটে যায় ব্র্যান্ডেড দোকানে। মেয়েদের শাড়ির সঙ্গে এখন মিশেছে ইন্দো-ওয়েস্টার্ন ড্রেস, গাউন বা লেহেঙ্গা। ছেলেদের মধ্যে প্রচলিত হয়েছে জিন্সের সঙ্গে কুর্তা বা স্টাইলিশ জ্যাকেট।


গয়নার ক্ষেত্রেও এসেছে পরিবর্তন। আগের মতো শুধু সোনা বা রূপার গয়নায় সীমাবদ্ধ না থেকে এখন মেয়েরা ফ্যাশন জুয়েলারি, কস্টিউম জুয়েলারি কিংবা অক্সিডাইজড সেটে সাজতে ভালোবাসে। মেকআপও এখন আলাদা জায়গা নিয়েছে। পেশাদার মেকআপ আর্টিস্ট, পার্লার সেবা, হেয়ারস্টাইলিং—সবই আজকের সাজের অপরিহার্য অংশ।
বাড়ির সাজও পাল্টেছে। ফেয়ারি লাইট, থিমেটিক হোম ডেকর, মোমবাতি, কৃত্রিম ফুল আর ওয়াল হ্যাঙ্গিং এখন আধুনিক সাজের অংশ। অনেকেই নিজেদের ঘরে পুজো-স্পেশাল ফটো কর্নার সাজিয়ে তোলেন, যা একালে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি আপলোড করার বড় আকর্ষণ।
বদলের আনন্দ আর নস্টালজিয়া
যদিও একালের সাজ অনেক ঝলমলে, সেকালের সাজে ছিল সহজ সরল আনন্দ। তখন সাজ মানে ছিল নিজের হাতে তৈরি করা কিছু, পরিবারের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া। আজকের দিনে সাজ অনেকটাই ভোগবিলাস আর প্রদর্শনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে। ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামের ছবি যেন সাজের মূল্য নির্ধারণ করে।
তবু এ কথাও সত্যি, পরিবর্তনই জীবনের নিয়ম। একালের সাজ আমাদের আধুনিক জীবনযাপনের প্রতিফলন, আবার সেকালের সাজ আমাদের শিকড়ের টান। দুয়ের মিলনেই পুজোর সাজ আসলে সম্পূর্ণ হয়।
পুজোর সাজ কেবল রঙিন পোশাক বা গয়নার প্রদর্শনী নয়, এটি বাঙালির সংস্কৃতিরও পরিচয়। একালের ঝলকানি আর সেকালের সরলতার মাঝেই আমরা খুঁজে পাই উৎসবের আসল রূপ—আনন্দ, মিলন আর স্নেহের আবহ। তাই পুজোর সাজ হোক একালের আধুনিকতায় মোড়া, কিন্তু তার ভেতরে থাকুক সেকালের আন্তরিকতার আলো।