বিশ্বজনীন শারদ উৎসবে বাংলার শাড়ি কেন পিছিয়ে?
কলকাতার শরৎ সকাল—অক্টোবরে মেঘের ফাঁক দিয়ে রোদের ফালি যখন সোনালি রঙে ভিজিয়ে দেয় রাস্তাঘাট, তখন থেকেই শুরু হয় প্যান্ডেল ঘোরা। ঢাকের তালে, ধূপের গন্ধে আর কাশফুলের দোলায় মেতে ওঠে শহর ও গ্রাম। একসময় এই দৃশ্যের অপরিহার্য অংশ ছিল শাড়ি—সাদা গরদে লাল পাড়, ধনেখালি, বালুচরি কিংবা মুর্শিদাবাদি সিল্কে সেজে উঠতেন মেয়েরা।
কিন্তু এখন সেই ছবি বদলেছে। পূজোর সকালেও চোখে পড়ে গাউন, লেহেঙ্গা, কুর্তি-পালাজো, এমনকি ওয়েস্টার্ন ড্রেস। বদলে গেছে বাঙালির পূজোর ফ্যাশন।

শাড়ি থেকে ফিউশন: পরিবর্তনের পথচলা
৯০-এর দশক পর্যন্ত পূজোর বাজার মানেই শাড়ি কেনার ধুম। টাঙ্গাইল, ধনেখালি, কাতান, বালুচরি—প্রতিটি ঘরানার শাড়ির নিজস্ব মর্যাদা ছিল। কিন্তু ২০০০ সালের পর থেকে গ্লোবাল ফ্যাশন, টিভি সিরিয়াল, বলিউড, সোশ্যাল মিডিয়া—সব মিলে তরুণ প্রজন্মের কাছে শাড়ি ‘ঐতিহ্যবাহী কিন্তু ঝামেলাপূর্ণ পোশাক’ হিসেবে পরিচিতি পেতে থাকে। সহজ পরিধেয় ও দ্রুত মানিয়ে নেওয়া যায় এমন পোশাকের দিকে ঝুঁকতে শুরু করে বাজার।
বিশ্ববাজারে বাংলার শাড়ি: পরিসংখ্যানের গল্প

ভারতের শাড়ি বাজারের বর্তমান মূল্য প্রায় ৫.৭৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (২০২৪)। হ্যান্ডলুম শাড়ির বিশ্ববাজার ২০২৪ সালে ৩.৭২–৮.৩২ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত অনুমান করা হয়েছে, যেখানে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের শেয়ার সবচেয়ে বড়। গত এক বছরে ভারত থেকে ৭৫,০০০+ শাড়ি শিপমেন্ট বিশ্বে গেছে, যা চাহিদা বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়।
পশ্চিমবঙ্গ ভারতের মোট টেক্সটাইল উৎপাদনের প্রায় ৮% অবদান রাখলেও আন্তর্জাতিক বাজারে বালুচরি, মুর্শিদাবাদি সিল্ক বা ধনেখালির ব্র্যান্ড-দৃশ্যমানতা এখনও দক্ষিণ ভারতের কাঁজিেভরম বা উত্তর ভারতের বানারসির তুলনায় অনেক কম।

কেন পিছিয়ে বাংলার শাড়ি?
১. মার্কেটিংয়ের ঘাটতি – বানারসি ও কাঁজিেভরমের মতো আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডিং ও প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণের হার কম।
২. ডিজাইন ইনোভেশনের অভাব – তরুণ প্রজন্মের চাহিদা অনুযায়ী ফিউশন বা প্রি-স্টিচড শাড়ির সরবরাহ সীমিত।
৩. দামের অসামঞ্জস্য – হ্যান্ডলুম শাড়ির দাম বেশি হলেও ব্র্যান্ড ভ্যালুর অভাবে ক্রেতা তা ন্যায্য মনে করেন না।
৪. রপ্তানি চ্যানেলের সীমাবদ্ধতা – একক শিল্পীর পক্ষে আন্তর্জাতিক লজিস্টিক ও মার্কেট রিচ পাওয়া কঠিন।
আন্তর্জাতিক তুলনা
দক্ষিণ ভারতের কাঁজিেভরম ও উত্তর ভারতের বানারসি—দু’টি শাড়িই আন্তর্জাতিক বাজারে দীর্ঘদিন ধরে সাফল্য পেয়েছে। এর পেছনে রয়েছে সুসংগঠিত মার্কেটিং, বিদেশি প্রদর্শনী, অনলাইন উপস্থিতি এবং ট্যুরিজমের সঙ্গে সংযোগ। তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী শাড়ি শিল্প ছোট পরিসরে সীমাবদ্ধ, প্রয়োজন বৃহত্তর বাজারে প্রবেশ।

কারিগরের দীর্ঘশ্বাস
বর্ধমানের এক তাঁতি বললেন,
“আগে পূজোর আগে ৩০-৪০টা শাড়ির অর্ডার পেতাম, এখন ১০টার বেশি হয় না। ছেলে-মেয়েরা বলে, শাড়ি পরে অসুবিধা।”
সমাধানের পথ
- ফিউশন ডিজাইন: প্রি-স্টিচড ড্রেপ, হালকা কাপড়, মডার্ন ব্লাউজ কাট।
- ডিজিটাল মার্কেটিং: আন্তর্জাতিক বাঙালি সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে অনলাইন প্রমোশন।
- ক্লাস্টার-ব্র্যান্ডিং: বালুচরি, মুর্শিদাবাদি বা ধনেখালিকে GI ট্যাগসহ আন্তর্জাতিক ফ্যাশন শোতে তুলে ধরা।
- রপ্তানি সহায়তা: এক্সপোর্ট কনসোর্টিয়াম গঠন, ট্রেড ফেয়ারে অংশগ্রহণ ও লজিস্টিক সাপোর্ট।
শাড়ি শুধু পোশাক নয়, এক সংস্কৃতির প্রতীক। গ্লোবাল ফ্যাশনের স্রোতে ভেসে গিয়ে যদি আমরা এই ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলি, তাহলে পূজোর সকাল হারাবে তার অন্যতম রঙ। বিশ্বজনীন শারদ উৎসবেও বাংলার শাড়ি আবার যদি গর্বের আসন ফিরে পায়, তবে সেটাই হবে আসল সাংস্কৃতিক জয়।