বাংলা সিনেমার ইতিহাসে যখন আমরা নক্ষত্রদের নাম করি, তখন অনেকে থাকেন আলো ঝলমলে আকাশে—নায়ক-নায়িকা, জনপ্রিয় মুখ। কিন্তু সেই আকাশেই কিছু নক্ষত্র আছেন, যাঁদের আলো নিভৃত, গভীর আর চিরকালীন। তাঁদের ভরসাতেই গড়ে উঠেছে বাংলা চলচ্চিত্রের ভিত্তি। কালী প্রসাদ ব্যানার্জী সেই বিরল শ্রেণির একজন—যিনি হয়তো আলোয় ছিলেন না, কিন্তু আলো সৃষ্টি করেছিলেন।

শৈশব ও শুরু
১৯২১ সালের ২০ নভেম্বর বর্ধমানে জন্ম কালী ব্যানার্জীর। ছোটবেলা থেকেই নাটকের প্রতি তাঁর অদম্য টান। গ্রামীণ আসরের মাটির গন্ধমাখা নাট্যমঞ্চেই প্রথম তাঁর অভিনয়ের হাতেখড়ি। সংসারের টানাপোড়েন সামলাতে নানা কাজ করেছেন, কিন্তু মনের ভেতরের শিল্পী তাঁকে টেনে নিয়ে আসে সিনেমা ও মঞ্চের দিকে।

সিনেমায় প্রথম পদক্ষেপ
চল্লিশের দশকে তিনি সিনেমায় পা রাখেন। প্রথম দিকের ছবিগুলোতে ছোট চরিত্রেই দেখা যেত তাঁকে। কিন্তু খুব দ্রুতই বোঝা গিয়েছিল—এই মানুষটি আলাদা। তাঁর মুখের অভিব্যক্তি, সংলাপ বলার ভঙ্গি আর শরীরী ভাষা চরিত্রকে এমনভাবে জীবন্ত করে তুলত যে দর্শকরা ভুলতে পারতেন না।

‘পরশ পাথর’ : এক অনন্ত মাইলফলক
১৯৫৫ সালে সত্যজিৎ রায়ের ‘পরশ পাথর’ তাঁকে অমর করে তোলে। একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষের হঠাৎ সম্পদলাভ আর তার পরবর্তী বিপদের গল্পে কালী ব্যানার্জী এমন এক চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছিলেন, যা আজও বাংলা সিনেমার কালজয়ী সম্পদ। তাঁর সেই সরলতা, সেই লোভ, সেই অসহায়তা—সবকিছু এত নিখুঁতভাবে মিশে গিয়েছিল যে দর্শকরা মনে করেছিলেন, এ তো আমাদের আশেপাশেরই একজন মানুষ!

বৈচিত্র্যের ভাণ্ডার
‘পরশ পাথর’-এর বাইরে তাঁর অভিনয় ছড়িয়ে আছে অসংখ্য ছবিতে। ‘সাহেব বিবি গোলাম’, ‘জলসাঘর’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘বসন্ত বিলাপ’, ‘বনপলাশীর পদাবলী’—প্রতিটি ছবিতে তিনি একেক রকম চরিত্রে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে হাজির হয়েছেন। কখনো নিঃস্ব কৃষক, কখনো শহরের সাধারণ মধ্যবিত্ত, আবার কখনো রসিক গ্রাম্য মানুষ। চরিত্র যতই ছোট হোক, কালী ব্যানার্জীর উপস্থিতি পর্দাকে জীবন্ত করে তুলত।

মানুষের মতোই মানুষ
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অতি সাধারণ। তাঁর কাছে অভিনয় ছিল কাজ, নেশা নয়; খ্যাতি ছিল গৌণ, শিল্পই ছিল মুখ্য। সহকর্মীরা বলেন, তিনি ছিলেন নীরব, বিনম্র, মাটির মানুষ। পরিবারকে ভালোবেসে গেছেন, বন্ধুদের পাশে থেকেছেন। সিনেমার বাইরে তিনি কখনো নিজেকে বড় করে দেখাতে চাননি।
স্বীকৃতির আক্ষেপ
অভিনয় জীবনে তাঁর মতো প্রতিভাবান শিল্পী বড় পুরস্কার পাননি। এ এক ধরনের বেদনা, যা আজও বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে প্রশ্ন তুলে দেয়—কেন এমন অভিনেতারা যথাযথ সম্মান পান না? তবে সত্যিকারের শিল্পীর পরিচয় থাকে তাঁর কাজেই। আর কালী ব্যানার্জীর কাজ আজও নতুন প্রজন্মের অভিনেতাদের প্রেরণা দেয়।

অন্তিম অধ্যায়
১৯৯৩ সালের ৫ জুলাই কালী ব্যানার্জী চিরবিদায় নেন। সংবাদপত্রে বড় করে ছাপা হয়নি তাঁর মৃত্যু সংবাদ, প্রচারের আলো জ্বলেনি। কিন্তু বাংলা সিনেমার ভক্তদের হৃদয়ে এক গভীর শূন্যতা তৈরি হয়েছিল। কারণ তাঁরা জানতেন, এক নিভৃত মহীরুহ ভেঙে পড়েছে।
চিরন্তন স্মৃতি
আজ এত বছর পরও কালী ব্যানার্জীর নাম উচ্চারিত হয় শ্রদ্ধার সঙ্গে। তিনি প্রমাণ করেছিলেন—নায়ক না হয়েও, প্রচারের আলোয় না থেকেও, এক জন অভিনেতা অমর হয়ে থাকতে পারেন। তাঁর জীবনের শিক্ষা এটাই—শিল্প কখনো প্রদর্শনের জন্য নয়, শিল্প আসল হয় যখন তা মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেয়। বাংলা সিনেমার ইতিহাসে কালী প্রসাদ ব্যানার্জী চিরকাল রয়ে যাবেন নিভৃতের আলোতে দীপ্ত এক শিল্পী হিসেবে—যিনি আমাদের শিখিয়ে গেছেন, সাধারণ মানুষই আসলে অসাধারণ গল্পের নায়ক।