আসন্ন বলিউড চলচ্চিত্র ‘Haq’ যে শুধু একটি সিনেমা নয় — এটি ভারতের বিচারব্যবস্থা, ধর্মীয় আইন ও নারীর অধিকার নিয়ে এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের পুনর্নির্মাণ।
১৯৮৫ সালের Shah Bano Case ছিল ভারতের সংবিধানিক ইতিহাসে এমন একটি ঘটনা, যা মুসলিম মহিলাদের আইনগত সুরক্ষা ও ধর্মীয় ব্যক্তিগত আইনের মধ্যে ভারসাম্য নিয়ে চিরকালীন বিতর্কের জন্ম দেয়।
এই প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করব — কী ছিল শাহ বানো মামলার মূল তাৎপর্য, নতুন চলচ্চিত্র ‘Haq’ কীভাবে সেই ঘটনাকে তুলে ধরছে, এবং আজকের প্রেক্ষাপটে মুসলিম নারী-অধিকার ও আইনের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশ কী হতে পারে।
শাহ বানো মামলা — নারীর ন্যায়বিচারের প্রথম আলো

১৯৭৮ সালে ইন্দোরের এক মুসলিম মহিলা শাহ বানো বেগম তাঁর স্বামী মোহাম্মদ আহমেদ খান-এর কাছ থেকে তালাক প্রাপ্ত হন। তিনি বয়স্ক, নির্ভরশীল ও পাঁচ সন্তানের জননী ছিলেন। তালাকের পর তিনি তাঁর জীবিকা নির্বাহ করতে অক্ষম হয়ে পড়েন এবং আদালতের দ্বারস্থ হন।
তাঁর দাবি ছিল — স্বামীকে ভরণপোষণ দিতে হবে, কারণ তিনি তাঁর ওপর নির্ভরশীল।
কিন্তু স্বামী দাবি করেন — ইসলামী শরিয়ত অনুযায়ী, তিনি শুধু ‘ইদ্দত’ (প্রায় তিন মাস) পর্যন্তই আর্থিক সহায়তা দিতে বাধ্য।
এখানে আসে Criminal Procedure Code (CrPC)-এর ধারা ১২৫, যেখানে বলা হয়েছে — “যে স্ত্রী নিজে উপার্জন করতে অক্ষম, স্বামী তাকে ভরণপোষণ দিতে বাধ্য।” এই আইনের প্রযোজ্যতা ধর্মনিরপেক্ষ, অর্থাৎ তা সব সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেই কার্যকর।
সুপ্রিম কোর্ট ১৯৮৫ সালে এই মামলার রায়ে বলে — শাহ বানোও সেই আইনের অন্তর্ভুক্ত, এবং তাঁর স্বামী ভরণপোষণ দিতে বাধ্য।
এই রায়টি ছিল ঐতিহাসিক কারণঃ
- এটি প্রথমবার মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের সীমা অতিক্রম করে নারী-অধিকারকে সংবিধানের আলোয় প্রতিষ্ঠিত করে।
- আদালত বলেছিল — ধর্মের বাইরে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো ন্যায়বিচার ও সমতা নিশ্চিত করা।
- এই রায়ের মাধ্যমে আইন ও ধর্মের মধ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কের জন্ম হয়।
তবে, রায় ঘোষণার পর বড় ধরনের রাজনৈতিক চাপ ও ধর্মীয় প্রতিবাদ শুরু হয়। মুসলিম সমাজের একাংশ মনে করে, এটি শরিয়ত আইনের ওপর হস্তক্ষেপ।
ফলে ১৯৮৬ সালে ভারত সরকার পাশ করে Muslim Women (Protection of Rights on Divorce) Act, 1986, যেখানে বলা হয়, মুসলিম স্বামী শুধুমাত্র ‘ইদ্দত’ সময়ের জন্যই স্ত্রীকে আর্থিক সহায়তা দেবেন।
এই আইন কার্যত সুপ্রিম কোর্টের রায়কে দুর্বল করে দেয়।
তবুও শাহ বানো মামলা হয়ে ওঠে এক প্রতীক — একজন সাধারণ মুসলিম নারীর ন্যায়ের লড়াইয়ের প্রতীক।
সিনেমা ‘Haq’ — আইনি ইতিহাসের পুনর্জন্ম

২০২৫ সালের নভেম্বরে মুক্তি পাচ্ছে ‘Haq’, পরিচালনায় সুপরণ এস বর্মা। সিনেমাটি শাহ বানো মামলার অনুপ্রেরণায় নির্মিত, যেখানে নারী-অধিকার, ধর্মীয় প্রথা ও সংবিধানের সংঘাতকে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে।
চলচ্চিত্রে মুখ্য ভূমিকায় রয়েছেন ইমরান হাশমি ও যামী গৌতম।
ট্রেলারে দেখা যায় এক সাহসী মহিলা আইনজীবীর লড়াই—যিনি ধর্মীয় প্রতিরোধ, সামাজিক লজ্জা ও আইনি কাঠামোর মধ্যে ন্যায় প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন।
‘Haq’ সিনেমার গুরুত্ব তিনভাবে বোঝা যায়ঃ
- সচেতনতার পুনর্জাগরণ: শাহ বানো মামলার মতো ঐতিহাসিক ঘটনাকে নতুন প্রজন্মের সামনে আনার সুযোগ দিচ্ছে।
- সামাজিক বিতর্কের পুনরুত্থান: চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ব্যক্তিগত আইন ও নারী-অধিকার প্রসঙ্গে নতুন করে আলোচনা শুরু হবে।
- শিল্প ও বাস্তবতার সংঘাত: পরিবার ও সমাজের সম্মতি ছাড়া বাস্তব জীবনের গল্প ব্যবহার করা নিয়ে বিতর্ক উঠেছে, যা প্রশ্ন তোলে—‘কোনটা ইতিহাস, আর কোনটা সিনেমাটিক স্বাধীনতা?’
তবে চলচ্চিত্রটি যদি সংবেদনশীলতার সঙ্গে নির্মিত হয়, তাহলে এটি শুধুমাত্র এক আইনি নাটক নয় — এটি হতে পারে এক প্রজন্মের নারীর কণ্ঠস্বরের পুনর্জাগরণ।
মুসলিম নারী ও ব্যক্তিগত আইন — এখন কোথায় দাঁড়িয়ে?

শাহ বানো মামলার চার দশক পরে আজও প্রশ্ন একই—ব্যক্তিগত আইন ও সমানাধিকারের মধ্যে ভারসাম্য কোথায়?
১. ভরণপোষণ ও আইনি সুরক্ষা
আজও বহু মুসলিম মহিলা বিবাহবিচ্ছেদের পর আর্থিক অনিশ্চয়তার মুখে পড়েন। আদালত বারবার স্পষ্ট করেছে — CrPC ধারা ১২৫ সব ধর্মের জন্য প্রযোজ্য, এবং কোনো ধর্মীয় আইন তার ওপরে নয়।
এই নির্দেশনা নারীদের সংবিধানিক সুরক্ষার প্রতীক হলেও, সামাজিকভাবে এর বাস্তবায়ন আজও অসম্পূর্ণ।
২. ব্যক্তিগত আইন বনাম সংবিধান
ভারতে Uniform Civil Code (UCC) নিয়ে বহু বিতর্ক হয়েছে। একদিকে অনেকে বলেন — এটি সমানাধিকারের দিক থেকে প্রয়োজনীয়, অন্যদিকে অনেকেই মনে করেন — এটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্বায়ত্তশাসনে হস্তক্ষেপ।
শাহ বানো মামলা এই দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল এবং আজও সেই বিতর্ক জীবন্ত।
৩. নারীর কণ্ঠ ও নেতৃত্ব
আজকের প্রেক্ষাপটে বহু মুসলিম মহিলা সংগঠন যেমন ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলন (BMMA) নারীদের শিক্ষা, আইনি সচেতনতা ও ধর্মীয় সংস্কারের দাবিতে কাজ করছে।
তারা দাবি করছে — শরিয়তকে আধুনিক ন্যায়বিচারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে, যাতে নারী-পুরুষ উভয়ের অধিকার রক্ষিত হয়।
৪. নতুন প্রজন্মের মানসিকতা
যুব প্রজন্ম এখন প্রশ্ন করছে—ধর্ম ও আইনকে কি আলাদা করে দেখা উচিত, না কি তাদের সমন্বয়ে মানবিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব?
‘Haq’ সিনেমা এই প্রজন্মের সেই প্রশ্নগুলোকেই বড় পর্দায় প্রতিফলিত করছে।
১৯৮৫-এর শাহ বানো মামলা ভারতের আইনি ইতিহাসে এক যুগান্তকারী মুহূর্ত। এটি ছিল এমন এক সময়, যখন একজন সাধারণ মুসলিম নারী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়, বরং অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন।
আজ, প্রায় চল্লিশ বছর পর, চলচ্চিত্র ‘Haq’ সেই ইতিহাসকে নতুন আলোয় ফিরিয়ে আনছে। এটি শুধু অতীতের স্মরণ নয়, বরং বর্তমানের প্রশ্ন—
👉 ধর্মীয় আইন কি কখনো নারীর সমানাধিকারের বিকল্প হতে পারে?
👉 আইনের ব্যাখ্যা কি মানবিক হতে পারে?
👉 এবং সমাজ কি প্রস্তুত তার নারীদের ন্যায়ের দাবিকে স্বীকার করতে?
‘Haq’ চলচ্চিত্র এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার একটি সাংস্কৃতিক উদ্যোগ, যা আবারও মনে করিয়ে দেয়—ন্যায়, সমতা ও মানবতা — এই তিনই রাষ্ট্রের প্রকৃত ভিত্তি।






