কলকাতা, আগস্ট ২০২৫ – আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, কলকাতার আকাশে ভেসে উঠেছিল এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। সেদিনই আনুষ্ঠানিকভাবে সম্প্রচার শুরু করে বাঙালির প্রথম টেলিভিশন চ্যানেল দূরদর্শন কলকাতা। তখনও টেলিভিশন ছিল বিরল, বিলাসবহুল এক জিনিস। কিন্তু যাঁরা দেখেছিলেন, তাঁদের জীবনে সেটাই হয়ে ওঠে বিনোদন, শিক্ষা আর সংস্কৃতির একমাত্র জানালা।
সাদা-কালোর সেই দিনগুলো
সত্তরের দশকের মাঝামাঝি টিভি ছিল হাতেগোনা কয়েকজনের কাছে। একেকটি এলাকায় এক বা দুইটি বাড়িতে টিভি থাকত, আর আশপাশের মানুষ ভিড় জমাত সেই ঘরে। সাদা-কালো ছবিতে খবর, গান, নাটক, নৃত্য, কুইজ শো—সবই যেন এক অন্যরকম আবিষ্কার। সন্ধ্যা মানেই একসাথে বসে দূরদর্শন দেখা, আর সেটাই হয়ে উঠেছিল পারিবারিক আনন্দের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের ঝলক
দূরদর্শনের অবদান শুধু বিনোদনে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং এক প্রজন্মের আবেগ ও স্মৃতিকে গড়ে তুলেছিল।
‘চিত্রহার’: সিনেমার গান মানেই শনিবার সন্ধ্যার চিত্রহার।
‘রামায়ণ’ ও ‘মহাভারত’: রবিবার সকালে এই ধারাবাহিক দেখার জন্য গোটা দেশ রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যেত।
‘কৃষি দিগন্ত’: কৃষক সমাজের জন্য অপরিসীম জ্ঞানের উৎস হয়ে উঠেছিল।
বাংলা নাটক ও রবীন্দ্রজয়ন্তী বিশেষ অনুষ্ঠান: বাঙালি সংস্কৃতিকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিল।
সাপ্তাহিক সংবাদ: নির্ভরযোগ্য তথ্যের একমাত্র মাধ্যম ছিল অনেকের কাছে।
শুধু শহরেই নয়, গ্রামবাংলাতেও মানুষ দূরদর্শনের মাধ্যমে যুক্ত হয়েছিল মূল স্রোতে।

রঙিন টেলিভিশনের আগমন
১৯৮২ সালের এশিয়ান গেমস ভারতের ইতিহাসে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। সেবারই প্রথমবার দূরদর্শনে রঙিন সম্প্রচার শুরু হয়। সাদা-কালো থেকে রঙিন টেলিভিশনে রূপান্তর এক বিশাল উত্তেজনা তৈরি করেছিল। শহরের বড় দোকানগুলোতে রঙিন টিভির সামনে ভিড় জমত, শুধু ওই অভিজ্ঞতা নিতে।

সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন
দূরদর্শনের আরেকটি বড় অবদান ছিল সংস্কৃতিকে একসূত্রে বাঁধা। প্রখ্যাত শিল্পী, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ—সবাই দূরদর্শনের পর্দায় জায়গা পেয়েছিলেন। কলকাতা থেকে মুম্বাই, দিল্লি থেকে চেন্নাই—ভারতের বৈচিত্র্যকে একত্র করেছিল এই চ্যানেল। জাতীয় দিবস বা প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠান সরাসরি দেখা যেত দূরদর্শনের মাধ্যমে, যা সাধারণ মানুষকে দেশের মূলস্রোতের সাথে যুক্ত করত।
পরিবর্তনের হাওয়া
নব্বইয়ের দশকে স্যাটেলাইট চ্যানেলের আগমন ঘটলে দূরদর্শনের একচ্ছত্র আধিপত্যে ভাটা পড়ে। স্টার, জি, সান, ইটিভি—একাধিক চ্যানেল নতুন ধারা নিয়ে আসায় দর্শক বিভক্ত হতে শুরু করে। তবে দূরদর্শনের প্রতি প্রবীণ প্রজন্মের টান কমেনি। কারণ সেই একচ্যানেলের দিনগুলোতে যে নস্টালজিয়া তৈরি হয়েছিল, সেটি বহুচ্যানেলের যুগেও অক্ষুণ্ণ রয়ে গেছে।

নিঃশব্দ স্বর্ণজয়ন্তী
আজ যখন দূরদর্শন কলকাতা পঞ্চাশ বছরে পা দিল, তখন কোনো জমকালো উৎসব বা প্রচারের ঝলক চোখে পড়ল না। অথচ এই চ্যানেলই একসময় কোটি বাঙালির বিনোদনের একমাত্র ভরসা ছিল। সরকারি অনুষ্ঠান বা জাতীয় অনুষ্ঠান সম্প্রচারের দায়িত্ব এখনও দূরদর্শনের কাঁধেই থাকে, কিন্তু প্রজন্ম বদলের সঙ্গে সঙ্গে এর দর্শক সংখ্যা কমেছে বহুগুণে।
স্মৃতির পাতায় অমলিন
আজকের প্রজন্ম হয়তো নেটফ্লিক্স, ইউটিউব, ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মগ্ন। কিন্তু যাঁরা আশি-নব্বইয়ের দশকে বড় হয়েছেন, তাঁদের কাছে দূরদর্শন মানেই শৈশব-কৈশোরের স্মৃতির অ্যালবাম। পাড়ার ভিড়, রবিবার সকালের ধারাবাহিক, অথবা শীতের রাতে একসাথে বসে নাটক দেখা—এসবই বাঙালির আবেগের অংশ।
পঞ্চাশ বছর পার করে দূরদর্শন কলকাতা আজও প্রমাণ করে, প্রযুক্তি বদলালেও স্মৃতির টান কখনো মুছে যায় না। নিঃশব্দে হলেও এই স্বর্ণজয়ন্তী আসলে কোটি বাঙালির শৈশব-যৌবনের একসাথে ভাগ করা নস্টালজিয়ার উদযাপন।