বাংলার মাটিতে দুর্গাপুজো শুধু একটি ধর্মীয় আচার নয়, এটি বাঙালির প্রাণের উৎসব। শরৎকালের আকাশে সাদা কাশফুল দোলার সঙ্গে সঙ্গে হৃদয়ে যে আনন্দের ঢেউ ওঠে, তার শিকড় বহু পুরনো কাহিনি ও ঐতিহ্যে বাঁধা। বর্তমানের ঝলমলে থিম পুজো ও আলোকসজ্জার অনেক আগেই বাংলায় দুর্গাপুজো ছিল জমিদারবাড়ি, রাজবাড়ি ও বনেদি পরিবারগুলির গৌরবময় অধ্যায়। সেই প্রাচীন দুর্গাপুজো শুধু দেবী বন্দনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং সমাজ, সংস্কৃতি ও লোকজ ঐতিহ্যের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল।

দুর্গাপুজোর প্রাচীন সূত্রপাত
ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, বাংলায় প্রথম দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয় নবদ্বীপের কেতুপুরে, রাজা কংস নারায়ণের রাজবাড়িতে। পনেরো শতকের শেষ ভাগে এই পুজোর সূচনা হয়। পরে ধীরে ধীরে জমিদার ও রাজপরিবারের মধ্যে দুর্গাপুজো সামাজিক মর্যাদা ও গৌরবের প্রতীক হয়ে ওঠে। বাংলার নবাবি আমলে ধনসম্পদের প্রদর্শন, ক্ষমতার আস্ফালন এবং জনগণের সমাবেশ ঘটানোর অন্যতম ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়ায় এই উৎসব।

বনেদি বাড়ির পুজো : ঐতিহ্যের ধারক
কলকাতা ও তার আশেপাশের বনেদি পরিবারগুলি প্রাচীন দুর্গাপুজোর ধারা আজও বাঁচিয়ে রেখেছে। শোভাবাজার রাজবাড়ি, লাহা পরিবার, ঠাকুরবাড়ি, হাটখোলা দত্ত পরিবার বা বড়িশা চৌধুরিবাড়ির পুজো এখনও বাঙালির ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে। প্রতিটি বাড়ির পুজোর নিয়মকানুন, আচার-বিধি, এমনকি দেবী প্রতিমার রূপায়ণও আলাদা। কোথাও দশভূজা প্রতিমা, কোথাও আবার একচালায় একত্রিত পরিবার দেবীর রূপ। এই ভিন্নতা শুধু শিল্পের নয়, বরং পুরনো বিশ্বাস ও কুলাচারের প্রতিফলন।

আচার ও প্রথার বৈশিষ্ট্য
প্রাচীন পুজোগুলিতে দেবীর আরাধনা হত মূলত বৈদিক বা তান্ত্রিক পদ্ধতিতে। বলি ছিল অপরিহার্য—মহিষ বলি, ছাগ বলি বা লাউকুমড়ো বলি। ঢাকের বাদন, শঙ্খধ্বনি আর উলুধ্বনিতে রাজবাড়ির অন্দরমহল মুখর হয়ে উঠত। অতিথি আপ্যায়নের জন্য কয়েকদিন ধরে চলত ভুরিভোজ। রাজা-জমিদাররা পুজোর সময় প্রজাদের জন্য দরবার বসাতেন, যার মাধ্যমে সাধারণ মানুষ তাঁদের শাসকের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করতে পারতেন। ফলে দুর্গাপুজো হয়ে উঠেছিল শুধু ধর্মীয় আচার নয়, সামাজিক ও প্রশাসনিক এক মহোৎসব।

সমাজে পুজোর ভূমিকা
এই প্রাচীন পুজোগুলি ছিল গ্রামীণ ও শহুরে সমাজকে একত্রিত করার অন্যতম মাধ্যম। প্রজারা অপেক্ষা করত জমিদারবাড়ির দুর্গাপুজোর জন্য, কারণ সেই সময়ই তারা বিনোদন, নাটক, যাত্রা ও মেলার স্বাদ পেত। বহু ক্ষেত্রে এই পুজোর আয়োজনেই জন্ম নিয়েছিল বাংলার লোকনাট্য, কবিগান বা পালাগানের মতো শিল্পধারা। দুর্গাপুজো ছিল সামাজিক সংহতি ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের সেতুবন্ধ।

প্রাচীন থেকে আধুনিকের সেতুবন্ধ
যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীন বনেদি পুজোর ঐতিহ্য অনেকটাই হারিয়ে যাচ্ছে, তবু তাদের ছায়া এখনও বর্তমানের বারোয়ারি ও থিম পুজোয় খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিমার গঠন, আচার অনুষ্ঠান কিংবা সাংস্কৃতিক চর্চা—সবেতেই লুকিয়ে আছে সেই প্রাচীন রূপের ছোঁয়া। আধুনিকতার ঝলমলে আবহের মধ্যেও এই বনেদি পুজোগুলি আমাদের মনে করিয়ে দেয় শিকড়ের কথা, যেখানে দুর্গাপুজো শুধু উৎসব নয়, বাঙালির পরিচয়, ঐতিহ্য আর গর্বের প্রতীক।
বাংলার প্রাচীন দুর্গাপুজো শুধু মায়ের আরাধনার অনুষ্ঠান ছিল না, ছিল ইতিহাস, সংস্কৃতি, সমাজ ও রাজনীতির এক মহাসমারোহ। আজকের আলো ঝলমলে মণ্ডপ ও শিল্পিত প্রতিমার উত্থান হলেও, সেই বনেদি ঐতিহ্যের আলো নিভে যায়নি। বাঙালি এখনও গর্ব করে বলে—দুর্গাপুজো আমাদের প্রাণের উৎসব, আর তার শিকড় নিহিত সেই প্রাচীন জমিদারবাড়ির আঙিনায়, যেখানে একসময় ঢাকের আওয়াজে মুখরিত হত শরৎের আকাশ।